ব্লগ
কে জিততে চলেছে এবারের ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট? || শেষ পর্ব
Candidates 2nd part Schedule; Credit: Chess.com

কে জিততে চলেছে এবারের ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট? || শেষ পর্ব

chessorhistory
|

[২য় পর্ব পড়ুন] [১ম পর্ব পড়ুন]

ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট ২০২০-২১ বিষয়ক আমাদের চলমান সিরিজের তৃতীয় এবং শেষ পর্ব এটি। প্রথম পর্বে আমরা এই টুর্নামেন্টের নিয়মকানুন, প্রাইজমানি, এবং তিনজন প্রতিযোগী সম্পর্কে জেনেছি। দ্বিতীয় পর্বে বাকি পাঁচজন প্রতিযোগী এবং টুর্নামেন্টের পয়েন্ট তালিকা দেখেছি। সর্বশেষ আজকের পর্বে আমরা ক্যান্ডিডেটস সম্পর্কে সার্গে কারিয়াকিনের মন্তব্য জানবো, যিনি কিনা নিজে ২০১৬ ক্যান্ডিডেটসের চ্যাম্পিয়ন। সাথে সাথে ২০১৩, ২০১৪, ২০১৬ এবং ২০১৮ সবগুলো ক্যান্ডিডেটসের ফলাফল অনুযায়ী এবারের ক্যান্ডিডেটসকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো। সম্ভাব্য ফেবারিট বেরিয়ে আসবে পরিসংখ্যান ঘাঁটলেই! 

নেপো কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী হবে কার্লসেনের জন্য - কারিয়াকিন
ফিদে প্রেসিডেন্ট আরকাজি ভোরকোভিচ এবং বেশ ক’বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন আনাতোলি কারপভের সাথে গত ১৩ এপ্রিল মস্কো অফিসে এক সংবাদ সম্মেলনে বসেছিলেন সার্গে কারিয়াকিন। রাশিয়ার সরকারি সংবাদপত্র রুশিয়েস্কা গেজেটার উদ্যোগে আয়োজিত এই প্রেস কনফারেন্সে রিপোর্টাররা জুম কলের মাধ্যমে প্রশ্ন করেছিলেন। সেখানে কারিয়াকিনকে চেস ডট কম প্রশ্ন করে, প্রতিযোগিদের মধ্যে কে কার্লসেনের জন্য সবথেকে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী হবে। 

কারিয়াকিন বলেন,

এটা আসলেই কঠিন প্রশ্ন, প্রতিদ্বন্দ্বীদের সবাই শক্তিশালী। আর নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এমন একটা টুর্নামেন্ট জয়ের পর যে-কেউ আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে থাকে। সে নিজের সর্বোত্তম সত্ত্বাকে বের করে আনবে, এবং ম্যাগনাসের জন্য টাইটেল ডিফেন্ড করাকে যতটা সম্ভব কঠিন করে তুলবে। তবুও একজনের নাম যদি বলতেই হয়, তবে আমি ইয়ান নেপমনিয়াশির কথা বলবো। সে খুব শক্ত প্রতিপক্ষ হবে কার্লসেনের জন্য। সম্প্রতি শেষ হওয়া অনলাইন টুর্নামেন্টে (ম্যাগনাস কার্লসেন ইনভিটেশনাল) সে নিজেকে প্রমাণ করেছে। সেমিফাইনালে সে ম্যাগনাসকে হারিয়ে সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছে সে যোগ্য প্রতিপক্ষ।   

karjakin
২০১৬ ক্যান্ডিডেটস বিজয়ী সার্গে কারিয়াকিন; Image Courtesy: Niki Riga

পরিসংখ্যান কী বলে? 
ভবিষ্যতের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় কী? অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেয়া, এবং সেই অনুযায়ী ভবিষ্যদ্বাণী করা। এজন্য আমরা বিগত চার ক্যান্ডিডেটস নিয়ে হাজির হয়েছি; ২০১৩, ২০১৪, ২০১৬ এবং ২০১৮ ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট থাকবে আমাদের সামনে। সেই আলোকে এবারের বিজয়ী নির্ধারণের চেষ্টা করবো আমরা। তার আগে আজ ১৯ এপ্রিল-এর আগ পর্যন্ত সাত রাউন্ড শেষে পয়েন্ট তালিকায় চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক।

point table
সাত রাউন্ড শেষে পয়েন্ট টেবিল; Info Courtesy: FIDE

স্ট্যান্ডিংস অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে মাক্সিম এবং নেপো +২ স্কোর নিয়ে লিড দিচ্ছেন, ৫০% স্কোর নিয়ে মাঝ বরাবর আছেন চারজন- ফাবি, গিরি, হাও এবং গ্রিশচুক। আর -২ পয়েন্ট নিয়ে সারির পেছনে আছেন ডিং এবং কিরিল। এই পরিস্থিতিতে কী আশা করা সম্ভব? তার ধারণা পেতে এবার আমরা দেখবো আগের ক্যান্ডিডেটসগুলোর মাঝপথের স্কোর আর শেষের ফলাফল কেমন ছিল। একই থেকেছে নাকি হেরফের হয়েছে? সে অনুযায়ী এবারের ক্যান্ডিডেটস-এর গতিপথ কোনদিকে আগাচ্ছে তার আন্দাজ করার চেষ্টা করবো। 

লন্ডন ক্যান্ডিডেটস - ২০১৩ 
সাত রাউন্ড পর স্কোর: 

১। কার্লসেন ৫/৭

২। অ্যারোনিয়ান ৫/৭ 

৩। ক্রামনিক ৩.৫/৭ 

৪। সভিদলার ৩.৫/৭ 

ফাইনাল স্ট্যান্ডিংস:

১। কার্লসেন ৮.৫/১৪

২। ক্রামনিক ৮.৫/১৪ 

৩। সভিদলার ৮/১৪ 

৪। অ্যারোনিয়ান ৮/১৪ 

সেবার সেকেন্ড হাফের নাটক বেশ জমে যায় লন্ডনে। আর্মেনিয়ান গ্র্যান্ডমাস্টার লেভন অ্যারোনিয়ান টুর্নামেন্টের দ্বিতীয়ার্ধে পর পর তিনটি গেমে হেরে যান; কার্লসেনের অবস্থাও সুবিধার যাচ্ছিল না, তালিকার শেষদিকের ভাসিলি ইভানচুকের কাছে হারেন। অন্যদিকে ক্রামনিক একের পর এক জয় তুলে নিচ্ছিলেন। শেষ রাউন্ডে উত্তেজনার পারদ চরমে ওঠে যখন কার্লসেন-ক্রামনিক দুজনই হারেন, অপরদিকে সভিদলার-অ্যারোনিয়ান জিতে যান। তবুও শেষোক্ত দুজন ০.৫ পয়েন্ট পিছিয়ে থেকেই শেষ করেন, অপরদিকে ক্রামনিক কার্লসেনের সমান পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে থেকে গেলেও টাইব্রেকের নিয়মানুসারে জয়ের সংখ্যা বেশি হওয়ায় (৫-৪) ম্যাগনাসের গলায়ই বিজয়মাল্য ওঠে।  

magnus
২০১৩ ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট জিতে নেন বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস কার্লসেন; Image Courtesy: Wikimedia Commons

খান্তি-মানসিয়িস্ক ক্যান্ডিডেটস - ২০১৪

সাত রাউন্ড পর স্কোর:

১। আনন্দ ৪.৫/৭

২। অ্যারোনিয়ান ৪.৫/৭ 

৮। কারিয়াকিন ২.৫/৭

ফাইনাল স্ট্যান্ডিংস:

১। আনন্দ ৮.৫/১৪

২। কারিয়াকিন ৭.৫/১৪

লন্ডনের পর এবারেও লেভন টানা তিন গেম হেরে মঞ্চ থেকে ছিটকে যান। বিশ্বনাথন আনন্দ ধীরে সুস্থে নিজের গতিতে আগাতে থাকেন, যেভাবে শুরু থেকেই তার স্পিড ছিল। এদিকে কারিয়াকিন একের পর এক জয় তুলে মার্জিন যতটা সম্ভব কাছাকাছি আনেন। ১৩তম রাউন্ড দাঁড়ায় ভাগ্য নির্ধারণী, যদি কারিয়াকিন আনন্দের সাথে জিততে পারতেন, তাহলে পয়েন্টের ব্যবধান মাত্র অর্ধেকে এসে দাঁড়াত এবং আরও এক রাউন্ড বাকি ছিল। শেষে যদি স্কোর সমান হত কারিয়াকিন-আনন্দের, সেক্ষেত্রে জয়ের সংখ্যা বেশি বিবেচনায় জিতে যেতেন কারিয়াকিন; কিন্তু তিনি শেষতক আর পেরে উঠলেন না। আনন্দই টুর্নামেন্ট বিজয়ী হিসেবে আবির্ভূত হন। 

anand
ভারতীয় দাবাড়ু বিশ্বনাথন আনন্দ ২০১৪ ক্যান্ডিডেটসে জয়ী হন; Image Courtesy: Wikimedia Commons

মস্কো ক্যান্ডিডেটস - ২০১৬

সাত রাউন্ড পর স্কোর:

১। কারিয়াকিন ৪.৫/৭

২। অ্যারোনিয়ান ৪.৫/৭ 

৩। আনন্দ ৪/৭  

ফাইনাল স্ট্যান্ডিংস:

১। কারিয়াকিন ৮.৫/১৪

২। কারুয়ানা ৭.৫/১৪ 

৩। আনন্দ ৭.৫/১৪ 

মস্কোতেও আমরা দ্বিতীয় পর্বের মাহাত্ম্য দেখতে পাই- প্রথম সাত রাউন্ড শেষে যে কারুয়ানার খোঁজই ছিল না, তিনি কিনা টুর্নামেন্ট বিজয়ী হবার দৌড়ে সামনে চলে এলেন। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, টুর্নামেন্ট যদি কারুয়ানা-কারিয়াকিন দুজন সমান পয়েন্ট নিয়ে শেষ করেন, তবে জয়সংখ্যার মার্জিনে এগিয়ে থেকে কারিয়াকিন বিজয়ী হবেন। কারুয়ানা হলেন অগ্নি-পরীক্ষার সম্মুখীন, কারণ জয়ের সংখ্যার হিসেবে কারিয়াকিন এগিয়ে। সে হিসেবে ১৩তম রাউন্ড দাঁড়াল সবথেকে ডিসাইসিভ, টুর্নামেন্ট জিততে চাইলে এই গেমে কারিয়াকিনকে হারাতেই হতো ফাবির। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, শার্প সিসিলিয়ান খেলেও শেষ রক্ষা হলো না ফাবির, হেরে গেলেন সার্গের কাছে। সার্গে কারিয়াকিন বিজয়ী হলেন পুরো টুর্নামেন্টের। এবং বরাবরের মতো এবারেও টুর্নামেন্টের দ্বিতীয়ার্ধে এসে দুটি হার এবং কোনো জয়ের মুখ না দেখে দৃশ্যপট থেকে গায়েব হয়ে গেলেন লেভন।

karjakin caruana
কারিয়াকিন-কারুয়ানার ডিসাইসিভ গেম দেখছেন সভিদলার ও তোপালভ (বামে); Image Courtesy: chess-news.ru

বার্লিন ক্যান্ডিডেটস - ২০১৮ 

সাত রাউন্ড পর স্কোর:

১। কারুয়ানা ৫/৭

২। মামেদিয়ারোভ ৪.৫/৭ 

৬। কারিয়াকিন ৩/৭ 

ফাইনাল স্ট্যান্ডিংস:

১। কারুয়ানা ৯/১৪

২। কারিয়াকিন ৮/১৪

৩। মামেদিয়ারোভ ৮/১৪ 

বার্লিনে কারুয়ানা ক্যান্ডিডেটস ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট (৯) পেয়ে বিজয়ী হন। আপাতদৃষ্টিতে দেখে মনে হবে, হেসেখেলেই জিতেছেন ফাবি। কিন্তু বিধি বাম; ১২তম রাউন্ডে কারুয়ানা যখন কারিয়াকিনের কাছে হেরে বসেন তখন তাদের স্কোর কিন্তু টাই হয়ে যায়। আর হেড-টু-হেড লড়াইয়ে কারিয়াকিনই ছিলেন এবারও এগিয়ে। কিন্তু শেষ অবধি আর সার্গে সেটি ধরে রাখতে পারেননি। শেষ ৮ গেমে ৫ পয়েন্ট তুলে নিয়ে এবারেও শেষাংশে দারুণ স্কোর করেন কারিয়াকিন, কিন্তু ফাবিকে আর ছুঁতে পারেননি। পজিশনাল কিং- ফাবিয়ানো 'দ্য চেস মেশিন' কারুয়ানা লন্ডনে আয়োজিত বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে ম্যাগনাসের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্যতা অর্জন করেন। 

caruana
এবারেও অন্যতম ফেবারিট ২০১৮ ক্যান্ডিডেটস-এর বিজয়ী কারুয়ানা; Image Courtesy: Getty Image/Kaspersky Lab

 
শেষ কথা

এখন উপর্যুক্ত তথ্যের আলোকে উপসংহারে আসা যাক- প্রথমত, এমভিএল বা নেপোর প্রথমার্ধের পয়েন্ট (৪.৫/৭) তাদের অর্ধেক কাজ শেষ হবার আভাস দেয়। দুজনই +২ পয়েন্ট পেয়ে গেছেন। তাদের কেউই আগে ক্যান্ডিডেটস খেলেননি, তাই আগের ফর্মের ভিত্তিতে কিছু বলার সুযোগ নেই। তবে সেকেন্ড-হাফ কলাপ্স বিবেচনায় নিলে নেপো পিছিয়ে পড়বেন, গত ২০১৯ এর গ্র্যান্ড সুইস ট্যুর এবং সিঙ্কফিল্ড কাপে তার দ্বিতীয়ার্ধে চোক করার অতীত ইতিহাস আছে। আবার হেড-টু-হেডেও সপ্তম রাউন্ডে এমভিএল তাকে হারিয়ে দেন গত বছর। মাক্সিম এদিক থেকে এগিয়ে থাকবেন। 

দ্বিতীয়ত, আগের প্রতিটি টুর্নামেন্টেই আমরা কিছু সেকেন্ড হাফ ওয়ারিয়র দেখেছি, যারা দ্বিতীয়ার্ধে বোর্ড কাঁপিয়েছেন। লন্ডনে যেমন ক্রামনিক, আর কারিয়াকিন তো লাগাতার তিন-তিনবার! ২০১৩ সাল থেকে নতুন নিয়মে ডাবল রাউন্ড রবিন সিস্টেমে ক্যান্ডিডেটস আয়োজিত হবার পর থেকে এ পর্যন্ত ফর্ম বিবেচনায়, তর্কসাপেক্ষে সার্গে কারিয়াকিনকে সেরা ক্যান্ডিডেটস যোদ্ধা খেতাব আমরা দিতেই পারি। সে আলাপ যাক, বলা হচ্ছিল সেকেন্ড হাফ ওয়ারিয়রদের নিয়ে। আগের দুজন তথা ক্রামনিক-কারিয়াকিনের কেউই এ আসরে নেই, তাই এবারের আসরে এই ভূমিকায় দেখা যেতে পারে ফাবিয়ানো কারুয়ানাকে। মার্কিন এই দাবাড়ুর ভেতর অনেকেই ভবিষ্যৎ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবার অপার সম্ভাবনা দেখেন। 

nepo mvl fabi giri
নেপো-মাক্সিম-ফাবি-গিরিতেই বিজয়ী দেখছেন বোদ্ধারা (বাঁ থেকে); Image Courtesy: FIDE

আবার অদূর ভবিষ্যতের ফর্ম ধর্তব্যে নিলে, আনিশ গিরিকে হেলাফেলা করার কোনো সুযোগই নেই। ২০২১-এই টাটা স্টিল চেস-এর রানার আপ এবং ম্যাগনাস কার্লসেন ইনভিটেশনাল-এ চ্যাম্পিয়ন এই দুটি ফলাফলই তার পারফরম্যান্স বোঝাতে যথেষ্ট। উল্লেখ্য, এই দুই টুর্নামেন্টে স্বয়ং ম্যাগনাস কার্লসেনও খেলেছিলেন। সবকিছু বিবেচনায় নেপো-এমভিএল-কারুয়ানা-গিরিতেই এবারের ক্যান্ডিডেটস বিজয়ী দেখছেন দাবাবোদ্ধারা। আর সঠিক ফলাফল জানতে- বেশি না, শুধু ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত অপেক্ষা করলেই হবে।

 


 
 
This article is the last part on the prediction of the winner of FIDE Candidates Tournament 2020-21. 

References: 

Featured Image: Chess.com
This article was first published at Roar Media/Bangla, you may find that there also.