ব্লগ
দাবার ঐতিহাসিক ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টের আদ্যোপান্ত
Candidates winner, later became champion; Credit: Wikimedia Commons

দাবার ঐতিহাসিক ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টের আদ্যোপান্ত

chessorhistory
|

আসছে মাসে রাশিয়ার ইয়াকাতেরিনবার্গে পর্দা উঠছে দাবার অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ আসর ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টের। দীর্ঘ এক বছর অপেক্ষার পর কোভিড-১৯ সামাল দিয়ে দাবার দুনিয়া আবার তৈরি জমজমাট আয়োজনের জন্য। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস কার্লসেনের প্রতিদ্বন্দ্বী নির্ধারণের অনবদ্য এই দক্ষযজ্ঞ উপভোগে আপনি প্রস্তুত তো?

সেরার সেরা আট দাবাড়ুর দুই রাউন্ড রবিন খেলা দেখার জন্য উন্মুখ পুরো বিশ্বের দাবাপ্রেমীরা। গত মার্চে হওয়ার কথা থাকলেও কোভিডের ধাক্কায় ফিদে মাঝপথে টুর্নামেন্টটি থামিয়ে দিতে বাধ্য হয়। বছরের মাঝে বারকয়েক চেষ্টা করলেও আর বাকিটুকু সারা যায়নি। আগামী ১৯-২৮ এপ্রিলে হবে টুর্নামেন্টের বাকিটুকু। আজকে আমরা একনজরে জানব ঐতিহাসিক এই ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টের পুরো ইতিহাস।

বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে দাবার বিশ্ববিজেতার মোকাবিলায় চ্যালেঞ্জার নির্ধারণের নিমিত্তে এই ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয়। এগারোতম আসর এবার ইয়াকাতেরিনবার্গে অনুষ্ঠিত হবে। রাশিয়া, কিংবা আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে সোভিয়েত ইউনিয়ন, বরাবরই ছিল দাবায় অগ্রগামী। দাবায় সোভিয়েত আধিপত্য বুঝতে হলে ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টের ফলাফল দেখাই যথেষ্ট। ১৯৯১ সালের আগে যে ছয়টি ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট আয়োজিত হয়েছে, তার প্রতিটিতেই বিজয়ী হয়েছেন কোনো না কোনো সোভিয়েত গ্র্যান্ডমাস্টার!  ইতিহাসে মাত্র চারজন দাবাড়ু ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট জয়ের পর চ্যাম্পিয়নশিপেও বিজয়ী হন। তাদের ছবি ফিচার ইমেজে দেখতে পাচ্ছেন, বাঁ থেকে ভাসিলি স্মিস্লভ, মিখাইল তাল, তিগ্রান পেত্রসিয়ান এবং হালের ম্যাগনাস কার্লসেন। ম্যাগনাস বাদে বাকি তিনজনই সোভিয়েত! 

magnus
হাস্যোজ্জ্বল ম্যাগনাস কার্লসেন, বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়ন; Image Courtesy: Lennart Ootes

হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে ১৯৫০ সালের মে মাসে প্রথম ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এতে দশজন দাবাড়ু অংশ নেন, যার মধ্যে সাতজন ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে। আইজ্যাক বোলেস্লাভস্কি ১২ পয়েন্ট নিয়ে ডেভিড ব্রন্সটেইনের সাথে প্রথম স্থান ভাগাভাগি করেন। পরবর্তীতে টাইব্রেকে বোলেস্লাভস্কিকে ৭.৫-৬.৫ পয়েন্টে হারিয়ে প্রথম ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট জিতে নেন ব্রন্সটেইন। 

দ্বিতীয় ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টে জয়ী হন ভাসিলি স্মিস্লভ। পনেরজন দাবাড়ু ডাবল রাউন্ড রবিনে খেলেন ১৯৫৩ সালে জুরিখে অনুষ্ঠিত এই ইভেন্টে। এই টুর্নামেন্ট সম্পর্কে বিশদে জানা যায় ব্রন্সটেইনের সুবাদে। তিনি একটি বই লেখেন এর উপর। সেই বইটি আরও কয়েকবার মুদ্রিতও হয়েছিল। ব্রন্সটেইনও এই টুর্নামেন্টে পল কেরেস আর স্যামুয়েল রেশেভস্কির সাথে যৌথভাবে দ্বিতীয় হন।

১৯৫৬ সালের ২৭ মার্চ থেকে ১লা মে, অ্যামস্টার্ডামে তৃতীয় ক্যান্ডিডেটসে লড়েন দশ দাবাড়ু। ডাবল রাউন্ড রবিনের এই আসরে দ্বিতীয়বারের মতো ক্যান্ডিডেটস জয়ের মাইলফলক অর্জন করেন স্মিস্লভ। পরবর্তীতে মিখাইল ময়সেভিচ বতভিনিককে হারিয়ে সেবারে বিশ্বচ্যাম্পিয়নের খেতাবও নিজের মুকুটে অঙ্কিত করেন এই সোভিয়েত গ্র্যান্ডমাস্টার। 

যুগোস্লাভিয়ার তিনটি শহর ব্লেড, বেলগ্রেড, জাগ্রেবে যৌথভাবে বসেছিল ক্যান্ডিডেটসের পরের আসর। ১৯৫৯ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর জুড়ে হওয়া এই ইভেন্টে অংশগ্রহণকারী আট দাবাড়ুর মধ্যে মিখাইল নেখমেভিচ তাল বিজয়ী হন। পরের বছর চ্যাম্পিয়নশিপে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে তৎকালীন সর্বকনিষ্ঠ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বনে যান তাল। 

tal
মিখাইল নেখমেভিচ দ্য এইটথ, তাল; যার উপাধি ছিল 'দ্য ম্যাজিশিয়ান ফ্রম রিগা'; Image Courtesy: Wikimedia Commons

১৯৬২ সালে পঞ্চম ক্যান্ডিডেটস আয়োজিত হয় দক্ষিণ আমেরিকার দ্বীপরাষ্ট্র কুরাশাওতে। এতে স্টকহোম ইন্টারজোনাল থেকে ছ’জন প্রতিযোগী অংশ নেন। টুর্নামেন্ট চলাকালেই তৃতীয় রাউন্ড শেষে মিখাইল তাল অসুস্থতাজনিত কারণে ছিটকে পড়েন। ববি ফিশার এই টুর্নামেন্টের ব্যাপারে অভিযোগ করেন যে, বিজয়ী যাতে সোভিয়েত কেউ হয়, এটা নিশ্চিত করতে সোভিয়েতরা যোগসাজশ করে খেলে। আয়রন তিগ্রান খ্যাত তিগ্রান পেত্রসিয়ান এই আসরে বিজয়ী হন।

সুদীর্ঘ ২৩ বছরের লম্বা বিরতির পর ১৯৮৫ সালে ফ্রান্সের মন্টপেলিয়েরে পরবর্তী আসর বসে। চারজন দাবাড়ু ফাইনাল রাউন্ডে যান, যেটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৮৬ সালে। যাদের মধ্যে বিজয়ী ১৯৮৭ সালের এই সুপারফাইনালে যাবেন, যেখানে তিনি আগেরবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ রিভেঞ্জ ম্যাচের পরাজিতের সাথে খেলবেন- এমন নিয়ম ছিল সেবার। ফাইনাল রাউন্ডে জিতে সোকোলোভ রিভেঞ্জ ম্যাচের পরাজিত আনাতোলি কারপভের সাথে সুপার ফাইনালে মুখোমুখি হন। সুপার ফাইনালে কারপভ বিজয়ী হন। 

karpov
যুবক বয়সে আনাতোলি কারপভ; Image Courtesy: Dutch National Archives

২০১৩ সালের মার্চে সপ্তম ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টের আসর বসে লন্ডনে। এতে বিজয়ী হন এবং পরবর্তীতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হন নরওয়ের ম্যাগনাস কার্লসেন। এখন অবধি তিনিই দাবার রাজমুকুট ধারণ করে আছেন। টুর্নামেন্টেটিতে ম্যাগনাসের সাথে বেশ হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয় ভ্লাদিমির ক্রামনিকের। শুরু থেকেই ম্যাগনাস এগিয়ে থাকলেও শেষের দিকে পাঁচ পয়েন্টের ভেতর চার পেয়ে প্রথম স্থান নিয়ে বসেন ক্রামনিক। তবে একদম শেষ রাউন্ডে ক্রামনিক হারেন এবং কার্লসেন জিতে যান। টাইব্রেকের নিয়মানুসারে জয়ের সংখ্যা বেশি হওয়ায় ম্যাগনাস কার্লসেন বিজয়ী হন। 

রাশিয়ার খান্তি-মানসিইস্কে ২০১৪ সালে আয়োজিত ক্যান্ডিডেটসে বিজয়ী হন ভারতের বিশ্বনাথন আনন্দ। বেশিরভাগ বোদ্ধাই ভেবেছিলেন চুয়াল্লিশ বছর বয়স্ক আনন্দের এই টুর্নামেন্টে ভালো করার কোনো সম্ভাবনাই নেই, এমনকি তিনিও এমনই ভেবেছিলেন। তবে বন্ধু ক্রামনিকের উৎসাহে তিনি অংশ নেন, এবং কোনো ম্যাচ না হেরেই টুর্নামেন্ট জিতে নেন। 

২০১৬ সালের মার্চে মস্কোতে নবম ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট আয়োজিত হয়। হোমবয় সার্গেই কারিয়াকিন বিজয়ী হন। এই আসরে কারিয়াকিনের সাথে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় মার্কিন জিএম ফাবিয়ানো কারুয়ানার। চৌদ্দতম রাউন্ডে তারা নিজেদের মধ্যে ডিসাইসিভ গেমে মুখোমুখি হয়। কারুয়ানা জয়ের পথেই ছিলেন, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে কারিয়াকিন তার রুক স্যাক্রিফাইস করেন এবং জয় ছিনিয়ে আনেন। সাথে প্রথম স্থানও তার হস্তগত হয়। 

karjakin
১৯৯০ সালে দাবাবিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার হিসেবে রেকর্ড গড়েন সার্গেই কারিয়াকিন, মাত্র ১২ বছর ৭ মাসে এই খেতাব অর্জন করেন তিনি (এখন পর্যন্ত অক্ষত এই রেকর্ড); Image Courtesy: Wikimedia Commons

দশম ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট বার্লিনে অনুষ্ঠিত হয় দশ থেকে সাতাশে মার্চ, ২০১৮ সালে। গত আসরের অন্যতম ফেবারিট ফাবিয়ানো কারুয়ানা এবার নিজের স্থান বুঝে নেন। শুরু থেকেই পুরো টুর্নামেন্টে লিড নিয়ে আসছিলেন ফাবি, কিন্তু সার্গেই মাঝের ছয় গেমে পাঁচ পয়েন্ট নিয়ে এগিয়ে আসেন; এমনকি নিজেদের মুখোমুখি এনকাউন্টারে ফাবিকে হারিয়ে ফার্স্ট লিড নেন কারিয়াকিনই। তবে শেষ দুই রাউন্ডে লেভন অ্যারোনিয়ান আর অ্যালেক্সান্ডার গ্রিশচুককে পরাজিত করে এক পয়েন্টের মার্জিনে এগিয়ে গিয়ে প্রথম স্থান পুনরুদ্ধার করেন ফাবি। ফলে এখন পর্যন্ত সর্বশেষ ক্যান্ডিডেট টুর্নামেন্টের বিজয়ী হন ফাবিয়ানো কারুয়ানা।

১৯৯৩ সালের আগপর্যন্ত ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হতো তিন বছর পর পর। ২০১৩ সালের পর থেকে এটি দুই বছর পর পর আয়োজিত হতে থাকে। নিয়ম এমন করা হয় যে, ক্যান্ডিডেটসের জন্য কোয়ালিফিকেশনের টুর্নামেন্টগুলো হবে বিজোড় সালগুলোতে, ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট হবে জোড় সালের শুরুতে এবং বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ হবে জোড় সালের শেষে। সেই সূত্র ধরেই এবারের একাদশ ফিদে ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের মার্চে, আর সেখানের বিজয়ীর সাথে বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস কার্লসেনের চ্যাম্পিয়নশিপের কথা ছিল গত বছরের শেষভাগে। কিন্তু কোভিড-১৯ এর করালগ্রাসে পুরো পৃথিবীই যেখানে থমকে গেছে, সেখানে দাবা আর কোন ছার! 

caruana
২০১৮ সালের ক্যান্ডিডেটস বিজয়ী কারুয়ানা (মাঝে) এবারেও ফেবারিট; Image Courtesy: FIDE 2020 Candidates Tournament Official Website

সর্বশেষ প্রাপ্ত সংবাদ অনুযায়ী, এবারের ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টের অষ্টম থেকে চৌদ্দতম রাউন্ড গেমগুলো হবে ১৯-২৭ এপ্রিলে। প্রথম সাতটি রাউন্ড কোভিড বিরতিতে যাবার আগে সম্পন্ন হয়েছে। সাত গেমে সাড়ে চার নিয়ে যৌথভাবে লিডে আছেন ফরাসি মাক্সিম ভাশিয়ার ল্যাগ্রাভ (এমভিএল) এবং রুশ ইয়ান নেপমনিয়াশি। আট দাবাড়ুর এই টুর্নামেন্টে আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মার্কিন হট ফেবারিট ফাবিয়ানো কারুয়ানা, ডাচ আনিশ গিরি, দুই চীনা ওয়াং হাও এবং ডিং লিরেন আর সবশেষে দুই রুশ অ্যালেক্সান্ডার গ্রিশচুক এবং কিরিল আলেকসেঙ্কো।

 
এপ্রিলে শেষ হওয়া ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টে বিজয়ীর সাথে ম্যাগনাসের সম্মুখসমরের কিন্তু দেরি নেই, বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে দেখা হয়ে যাবে ২৪ নভেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বরে। তো প্রিয় পাঠক, কে হচ্ছেন এবারের ক্যান্ডিডেটস উইনার? আর কে-ই বা হবেন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন? ম্যাগনাস কি পারবেন তার মুকুট ধরে রাখতে? আপনাদের কী মনে হয়? সঠিক উত্তর যে জানা যাবে আর কিছুদিনের মধ্যেই! 
 



 
This article is about the Candidates Tournament, a very prestigious tournament of chess. Here we briefly discussed the long history behind it. 

References: 

Feature Image: Wikimedia Commons; The only four players throughout history who have won world championships after winning the candidates; from left Smyslov, Tal, Petrosian and Carlsen. 

This article was first published at Roar Media/Bangla, you may find that there also.